মানবজমিন : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাড়ে ৪৬ শতাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে বলে মনে করছে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ইডব্লিউজি ৫৭টি ওয়ার্ডের ১২৯টি (৩০ শতাংশ) ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে। এতে ভোট প্রদানের গড় হার ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ। এই নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষণ করা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ১৫৯টি নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা ধরা পড়েছে। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে- জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে লেখা, কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে প্রচার চালানো ও ভোটকেন্দ্রের ভেতর অনুমোদিত ব্যক্তির বাইরের লোকজনের অবস্থান। এসব অনিয়মের বেশির ভাগই দুপুরের পর সংঘটিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন ইডব্লিউজির পরিচালক ড. আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, রংপুর সিটি নির্বাচনে আমরা কোনো অনিয়ম পাইনি। সেখানে ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে সবকিছুই হয়েছিল শান্তিপূর্ণ। কুমিল্লা এবং নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনেও তেমন একটা অনিয়ম পাওয়া যায়নি। তবে গাজীপুরে অনিয়ম পাওয়া গেছে। আব্দুল আলীম বলেন, ইডব্লিউজির নিয়োগকৃত পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ৯৮ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত ছিল। নির্ধারিত সময়েই ভোটগ্রহণের জন্য ভোটকেন্দ্র উন্মুক্ত করা হয়েছিল। ভোটগ্রহণ শুরুর আগে ব্যালট বাক্সগুলো যে খালি ছিল সেটা প্রমাণের জন্য পোলিং এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকদের সামনে ব্যালট বাক্স খোলা হয়েছিল। ভোটগ্রহণ শুরুর সময় সব ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ কেন্দ্রে ১ থেকে ২০ জন ভোটার, ২০ দশমিক ২ শতাংশ কেন্দ্রে ২০ থেকে ৪০ জন ভোটার এবং ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ কেন্দ্রে ৪০ জনেরও বেশি ভোটারের লাইন দেখা গেছে। ভোট গ্রহণের সময় ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষকরা ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট এবং ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে বিএনপি মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের দেখতে পেয়েছেন।

সংস্থাটি লিখিত বক্তব্যে জানায়, ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে দুপুরের দিকে চারটি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেন। ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সিল মারতে দেখা গেছে। একই কেন্দ্রে বিকাল চারটার দিকেও সিল মারার ঘটনা ঘটেছে। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে বেলা ১১টার দিকে পাঁচজন ভোটারকে মেয়র প্রার্থীর ব্যালট পেপার দেয়া হয়নি। বিএনপির পোলিং এজেন্টদেরও বের করে দেয়া হয়েছে। একই কেন্দ্রে বেলা একটার দিকে অবৈধভাবে সিল মারতে দেখা গেছে। দায়িত্বরত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা একজন মেয়র প্রার্থীর সরবরাহ করা খাবার গ্রহণ করেছেন। ২০ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে সারা দিন কিছুসংখ্যক অননুমোদিত ব্যক্তি কেন্দ্রের ভেতর ঘোরাফেরা করেছে। প্রিজাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গেও তাদের কথা বলতে দেখা গেছে। সংস্থাটি জানায়, তারা ৮৮টি কেন্দ্রে ভোটগণনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর মধ্যে ২১টি ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টরা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ বা আপত্তি জানিয়েছেন। দুটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ফলাফল শিটে একজন মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে লেখেন।

ওই সময় বিএনপির এজেন্ট উপস্থিত ছিলেন না। অনিয়মের ক্ষেত্রগুলো তুলে ধরে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ভোটগ্রহণ শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষকরা ৪৫ শতাংশ (৬০টি ভোটকেন্দ্র) ভোটকেন্দ্রে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে- জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজ ব্যাসার্ধ্বের ভেতরে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং ভোটকেন্দ্রের ভেতরে অননুমোদিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি। অনিয়মের কারণে পর্যবেক্ষণকৃত ১২টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এর মধ্যে ৯টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ পুনরায় চালু করা হয়। ইডব্লিউজি পর্যবেক্ষণকৃত ভোটকেন্দ্রে সর্বমোট ১৫৯টি নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। সংস্থাটির দাবি, তাদের লিপিবদ্ধ করা অনিয়মের ঘটনার মধ্যে ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার ঘটনা ৬টি কেন্দ্রে, ভোটারকে ভোটকক্ষে প্রবেশের পর আঙ্গুলে কালির ছাপ দিয়ে বলা হয়েছে আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে- এমন ঘটনার সংখ্যা ৩টি।

পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার ঘটনা ৩টি। পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ৬টি। ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ঘটনা ২৮টি। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে প্রার্থীর পক্ষ থেকে যানবাহন সরবরাহ করার ঘটনা ২৪টি। কেন্দ্রে অননুমোদিত ব্যক্তির উপস্থিতি দেখা গেছে ৩০টি। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে সহিংসতা ঘটেছে ৮টি এবং ভোটকেন্দ্রের বাইরে ৯টি। অবৈধভাবে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে ২১টি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এমন ঘটনা ৫টি ও অন্যান্য ১৬টি।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন ইডব্লিউজির সদস্য আব্দুল আওয়াল, ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, হারুনুর রশিদ প্রমুখ। ইডব্লিউজির সদস্য মো. হারুন-অর-রশীদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে রংপুরের মতো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আমরা প্রত্যাশা করি। সংস্থাটির আরেক সদস্য মো. আবদুল আওয়াল বলেন, ভোটগ্রহণ শুরুর সময়ে ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট দেখা গেছে। ভোট শুরুর পরে তাদের বের করে দেয়ার হিসাবটি আমাদের পর্যবেক্ষণে আসেনি। ইডব্লিউজি মডারেটর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ২০০৬ সালে ২৮টি সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সমন্বয়ে ইডব্লিউজি গঠিত হয়। সারা দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে সংস্থাটি। প্রতিটি নির্বাচন পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে আমরা প্রাথমিক প্রতিবেদন পেশ করি। আজ সেটি উপস্থাপিত হয়েছে। তবে নির্বাচন পরবর্তী ২১ দিনের মধ্যে ইডব্লিউজি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বলেও জানান তিনি।